বুধবার, ২৮ মে, ২০১৪

দালাল চক্র (কবুতরের কেস স্টাডি)

ইসহাক (রঃ) আবদুল্লাহ ইবন আবূ আওফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন,” এক লোক তার মালপত্র বাজারে এনে এবং হলফ করে বলল যে, এগুলো (খরিদ বাবদ) সে এত দিয়েছে, অথচ সে তত দেয়নি। তখন আয়াত নাযিল হলঃ যারা নগণ্য মূল্যের বিনিময়ে আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা এবং নিজের শপথ বিক্রি করে । ইবন আবূ আওফা (রাঃ) বলেন, (দাম চড়ানোর মতলবে) যে ধোকা দেয়, সে মূলতঃ সুদখোর ও খিয়ানতকারী।” (সহীহ বুখারি হাদিস নাম্বারঃ ২৪৯৭)


আল্লাহ্‌ বলেন, “তারা সে সমস্ত লোক, যারা হেদায়েতের বিনিময়ে গোমরাহী খরিদ করে। বস্তুতঃ তারা তাদের এ ব্যবসায় লাভবান হতে পারেনি এবং তারা হেদায়েতও লাভ করতে পারেনি।” (সূরা আল বাকারাঃআয়াত-১৬)



একবার আমাদের পার্শ্ববর্তি দেশে প্লেগ রোগ দেখা দিল। আর কিছু ডাক্তাররা বললেন যে, Tetracycline এই রোগের জন্য ভাল। তখন রাতারাতি এই ক্যাপসুলের দাম ২০ গুন বেড়ে গেল অর্থাৎ যে ক্যাপসুল ১ টাকা দাম ছিল সেটার দাম হয়ে গেল ২০ টাকা। তাও আবার পাওয়া যাচ্ছে না। অধিকাংশ মানুষ চিন্তাই পড়ে গেল। হায় হায় করতে লাগল। কি হবে ঔষধ না পেলে? আমরা সবাই তো তাহলে মারা যাব। রোগ কিন্তু তখন আমাদের দেশের থেকেও ১০০০ মাইল দূরে তারপরও আমাদের দুশ্চিন্তার অন্ত নাই। আর এই সুযোগেই কিছু অসাধু ব্যাবসায়ির পকেট গরম। আমাদের একটা মানসিক রোগ আছে আর তা হল, যে বেশী দামী জিনিষের প্রতি একটা আকর্ষণ বোধ করি সব সময়। মরিচের দাম বাড়তে শুরু করলে মরিচ কেনা বেড়ে যাই, চালের দাম বাড়লে চাল কেনা বেড়ে যায়। একবার রোজার সময় বেগুণের দাম বেড়ে গেল, আর মানুষের মধ্যে একটা কি ধরনের যেন হাহাকারও বেড়ে গেল, সবার মুখে মুখে, আরে ভাই বেগুণের দাম বেড়ে গেছে! আরে ভাই বেগুণের দাম বেড়ে গেছে! বেগুনি খেতে পারছি না…এখন কি করব? আর সভাবসুদ্ধ বেগুন কেনাও বেড়ে গেল, কি আশ্চর্য?! ব্যাপারটা অনেকটা এ রকম যে বেগুন বা বেগুনি না খেলে রোজা হবে না?! বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যখন কোন জিনিষের দাম বাড়ে তখন এর পরিবর্তে বিকল্প ব্যাবস্থা অবলম্বন করে। একবার চীনে খাদ্যাভাব দেখাদিলে তারা বিকল্প খাবার খাওয়া শুরু করল, আর এর মধ্যে কাঁকও এর অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলে তারা সেই বিপদ মুকাবেলা করতে পেরেছিল। (কেউ আবার ভুল বুঝবেন না অনুগ্রহ করে পুরাটা না পড়ে।) ছোট বেলায় জেনেছিলাম যে ভুতের উল্টা পা থাকে, আর রাতে ওরা মানুষের বেশ ধরে আসে! ভয়ঙ্কর ব্যাপার…রাতে তাই কারো সাথে দেখা হলে আগে পায়ের দিকে খেয়াল করতাম! যখন দেখতাম যে পা ঠিক আছে তখনি কেবল নিচিন্ত মনে কথা বলতাম। তবে ভাগ্য সুপ্রসন্ন আমার এখনও এই ধরনের উল্টা পায়ের মানুষ নামের প্রাণীর বা আত্মার সাথে দেখা হয়নি। তবে মানুষ নামের উল্টা মনের মানুষের প্রতিনিয়ত দেখা হয় কথা হয় উঠাবসা হয়। যদিও এদের চিনতে অনেক দেরি করে ফেলি, হয়ত অনেক কিছুর বিনিময়ে বা অনেক ক্ষতি স্বীকার করার পর। মাঝে মাঝে হতাশ হই, যে সৃষ্টিকর্তা যদি এই ধরনের উল্টা মনের মানুষকে চিনার ক্ষমতা দিতেন, তাহলে কতই না ভাল হত। তারপরও সৃষ্টিকর্তা ধন্যবাদ যে আমাদের মানুষ করে তৈরি করেছেন। আর আমারা যদি সারাদিন ধরে সাড়া জীবনভর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে থাকি তাহলেও শেষ হবে না।


বেশ কবছর আগে বাচ্চা পউটারের দাম ২৪ হাজার টাকাতেও অনুরধ করে কিনতে পারি নাই। আর সেটা আজ কত দাম? লক্ষা, সিরাজি, জরনা সার্টইন ইত্যাদি এমনভাবে অনেক কবুতর আজ অদৃশ্য হাতের কারসাজিতে রাতারাতি আকাশচুম্বী দাম হয়ে যাই। আবার রাতারাতি কমে এমন ভাবে নেমে আসে যেন মনে হয় আমারা নাগর দলায় আছি। কিছুদিন ধরে মুখি কবুতর নিয়ে মুখামুখি চলছে! সেই একই রোগ! মুখির দাম বাড়ছে, কাল,চকলেট,সিলভার অবশেষে ইয়েলো মুখিতে এসে ঠেকেছে। আমাকে একজন জানালেন, যে এটা ১ লক্ষ্য ২০ হাজার টাকা দাম…এখন!!! এই কবুতর বাজারের সাথে, আমার হটাত করে শেয়ার বাজারের সেই চক্রের কথা মনে পড়ে গেল। কারা এই চক্র আর কিইবা তাদের উদ্দেশ্য তা আমাদের জানা দরকার বা জানতে হবে যেকোনো মুল্যেই হোক। যদিও এই চক্রের সাথে কারা জরিত কমবেশী সবাই জানি, কিন্তু বলি না, কেন?


আবূ আসিম (রহঃ) আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেছেনঃ “আল্লাহর নিকট সেই লোক সবচেয়ে বেশী ঘৃণিত, যে অতি ঝগড়াটে।“(সহীহ বুখারি হাদিস নাম্বারঃ ২২৯৫)


হযরত সালত ইবনু মুহাম্মাদ (রহঃ) হযরত ইবনু আব্বাস (রাঃ) সূত্রে বর্নিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “তোমরা পন্যবাহী কাফেলার সাথে (শহরে প্রবেশের পূর্বে সস্তায় পন্য খরিদের উদ্দেশ্যে) সাক্ষাৎ করবেনা এবং শহরবাসী যেন গ্রামবাসীর পক্ষে বিক্রয় না করে।


রাবী তাউস (রহঃ) বলেন, আমি ইবনু আব্বাস (রাঃ) কে জিজ্ঞাসা করলাম, শহরবাসী যেন গ্রামবাসীর পক্ষে বিক্রয় না করে, [রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) -এর] একথার অর্থ কী? তিনি বললেন, তার হয়ে যেন সে প্রতারনামূলক দালালী না করে।“(সহীহ বুখারি হাদিস নাম্বারঃ ২০২৪)


আজ আমাদের নাম ছাড়া আর আমাদের মধ্যে কোন কিছুই ইসলামের লেশ মাত্র নাই। আমরা কয়টা টাকার জন্য ঈমান বিক্রি করে দেই! কয়টা টাকার জন্য আমরা ওয়াদা বিক্রি করে দেই! কয়টা টাকার জন্য আমরা আমাদের জবান/কথা বিক্রি করে দেই! কয়টা টাকার জন্য আমরা আমাদের বিশ্বাস বিক্রি করে দেই! কয়টা টাকার জন্য আমরা আমাদের জামীর বিক্রি করে দেই! কয়টা টাকার জন্য আমরা আমাদের আত্মা এমনি আমরা আমদের নিজেকে বিক্রি করতে পিছপা হইনা!!!


হযরত ইসহাক (রহঃ) হযরত হাকীম ইবনু হিযাম (রাঃ) সূত্রে বর্নিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “ক্রেতা-বিক্রেতার ইখতিয়ার থাকবে উভয়ের বিচ্ছিন্ন না হওয়া পর্যন্ত। যদি তারা উভয়ে সত্য কথা বলে এবং (পন্যের দোষগুন) যথাযথ বর্ননা করে, তবে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত দেওয়া হবে, আর যদি তারা মিথ্যা বলে এবং গোপন করে, তবে হয়ত খুব লাভ করবে কিন্তু তাদের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত মুছে যাবে। “(সহীহ বুখারি হাদিস নাম্বারঃ ১৯৮৪)


এইসব লোকদের আপনি কোন কোথাই বলে বুঝাতে পারবেন না। তারা এক কান দিয়ে শুনবে আরেক কান দিয়ে বের করে দিবে। ব্যাপারটা এমন যে, “তোরা যে যা বলবি বল,আমি কান করেছি ঢোল।”


আল্লাহ্‌ এদের সম্পর্কে বলেন, “আল্লাহ তাদের অন্তকরণ এবং তাদের কানসমূহ বন্ধ করে দিয়েছেন, আর তাদের চোখসমূহ পর্দায় ঢেকে দিয়েছেন। আর তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। তাদের অন্তঃকরণ ব্যধিগ্রস্ত আর আল্লাহ তাদের ব্যধি আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। বস্তুতঃ তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে ভয়াবহ আযাব, তাদের মিথ্যাচারের দরুন। তারা বধির, মূক ও অন্ধ। সুতরাং তারা ফিরে আসবে না। তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে দিও না এবং জানা সত্ত্বে সত্যকে তোমরা গোপন করো না। “ (সূরা আল বাকারাঃআয়াত-৭,১০,১৮ ও ৪২)


আমরা সবাই এক একজন আজব এক প্রাণী, যতক্ষণ আমরা আমদের নিজেদের লেজে (মানে ঘরে) আগুন না লাগে ততখন পর্যন্ত আমরা নিশ্চিন্ত, আমরা নাকে তেল দিয়ে বসে থাকি বা ঘুমায়। কিন্তু আমরা কেউ আমাদের জিম্মদারি থেকে দায়িত্ব এড়াতে পারব না। সেখানেই আর যে অবস্থাতেই থাকুক। আমরা কখনও এটা বলে পাশ কাটাতে পারব না যে, এটা আমার দায়িত্ব না।


ইসমাঈল (রহঃ) আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ “জেনে রেখো! তোমাদের প্রত্যেকেই একজন দায়িত্বশীল; আর তোমরা প্রত্যেকেই নিজ অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব ইমাম, যিনি জনগণের দায়িত্বশীল তিনি তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। পুরুষ গৃহকর্তা তার পরিবারের দায়িত্বশীল; সে তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। নারী তার স্বামীর পরিবার, সন্তান-সন্ততির উপর দায়িত্বশীল, সে এসব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। কোন ব্যাক্তির দাস স্বীয় মালিকের সম্পদের দায়িত্বশীল; সে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। অতএব জেনে রাখ, প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং তোমাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্বাধীন বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।“(সহীহ বুখারি হাদিস নাম্বারঃ ৬৬৫৩)


আমাকে কিছুদিন আগে একজন আমারই একটা পোস্টের মধ্যে মন্তব্য করলেন যে, ভাই আপনি লিখা অনেক বড় করেন পড়তে কষ্ট হয়। একটু ছোট করে লিখবেন। মন্তব্য পড়ে অবাক হলাম কিছুটা দুঃখও পেলাম। কিন্তু পরোক্ষনেই ভাবলাম! আরে আমি তো এই ধরনের লোকদের জন্য লিখিনা, আমি তো লিখি যারা বুঝবে পালন করবে তাদের জন্য! যদিও আমি যখন লিখা শুরু করি তখন উদ্দেশ্য থাকে আত বড় করার না, কিন্তু হয়ে যাই, তাও কিছু কথা মনের মধ্যেই থেকে যাই, কারন সব কথা তো আবার সব জাইগাই বলা যাই না!


পরিশেষে, একটা ঘটনা দিয়ে শেষ করছি। এক এলাকায় ফেতনা ফ্যাসাদ ও অন্যায় এত বেড়ে গেল যে,আল্লাহপাক ফেরেস্তাকে আদেশ করলেন যে, সে এলাকাকে ধ্বংস করে দিবার জন্ন,ফেরেস্তা সে এলাকাই গিয়ে দেখল যে, এক আল্লাহ্‌ বান্দা আল্লাহ্‌র ধ্যানে মগ্ন হয়ে আছে। ফেরেস্তা আল্লাহ্‌র কাছে ফিরে আসল ও আল্লাহ্‌র কাছে আরজ করলেন ইয়া আল্লাহ্‌ ওই জাইগাই আপনার এক খাস বান্দা আপনার ধ্যানে মগ্ন,সে সারাদিন রাত আপনার ইবাদত করে থাকে। তাকে কিভাবে এই আজবের মধ্যে ফেলে ধ্বংস করব? আল্লাহ্‌ সবই জানেন, তিনি ফেরেস্তাকে বল্লেন,হা তাকে সহই ধ্বংস করবে, আল্লাহ্‌ ফেরেস্তার মনভাব বুঝতে পেরে বললেন, সে আমার আমার ইবাদতে সারাদিন মগ্ন থাকে, কিন্তু তার এলাকায় যে, আত অন্যায় হয়, সে তার কোনদিন শারীরিক ভাবে বাধা দেইনি, মুখে কোন প্রকার প্রতিবাদ করিনি, অন্তর থেকে একবারের জন্যও ধিক্কার দেয়নি, আল্লাহ্‌র কাছে একবারের জন্য এদের থেকে পানাহ চাইনি। তাই সমান অপরাধী হিসাবে ওকেও ধ্বংস করার জন্য আল্লাহ্‌ নির্দেশ দিলেন।


হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন। আমি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, “তোমাদের কেউ যদি কোন পাপ কাজ সংঘটিত হতে দেখে, সে যেন তা হাত দিয়ে (শক্তি দ্বারা) বন্ধ করে দেয়। যদি সে এতে সমর্থ না হয়, তবে সে যেন মুখের (কথার) সাহায্যে (জনমত গঠন করে) তা বন্ধ করে দেয়। যদি সে এই শক্তিটুকুও না রাখে, তবে যেন অন্তরের সাহায্যে তা বন্ধ করার চেষ্টা করে। (কাজটির প্রতি ঘৃণা পোষণ করে)। আর এটা হলো ঈমানের দুর্বলতম (বা নিম্নতম) স্তর; এর নীচে ঈমানের আর কোন স্তর নেই।” (মুসলিম ১৮৪)


মূল লেখক : সোহেল রাবি ভাই



দালাল চক্র (কবুতরের কেস স্টাডি) BD Online Pigeon Market

দালাল চক্র (কবুতরের কেস স্টাডি)

Pigeon Discussion

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন