একদিন আমি মিরপুর থেকে মতিঝিল যাবার জন্য বাসে উঠলাম। চলার পথে জানালার পাশে বসে নানা ধরনের সাইন বোর্ড,বিল বোর্ড আর অ্যাড দেখছিলাম। এসব বিজ্ঞাপনে কত প্রতিশ্রুতি, এটা খেলে বুদ্ধি বাড়ে, ওটা খেলে তাড়াতাড়ি বাড়বে ইত্যাদি। হতাথ কন্টাক্টর আর এক যাত্রীর মধ্যে তুমুল ঝগড়া শুনে ঘার ফিরালাম। কি ব্যাপার জানার চেষ্টা করলাম। শেষে জানতে পারলাম যে, এক যাত্রী উত্তরা যাবেন কিন্তু ভুলে এই বাসে উঠে পড়েছেন! কিন্তু তিনি বাসের কন্টাক্টরকে ধমকাচ্ছেন। কেন সে তাকে বলেনি ইত্যাদি ইত্যাদি। শুধু এটাই না, তিনি যে শুধু ভাড়া দিবেন না তা নয় বরং উল্টো ভাড়া দাবি করে বসলেন। কন্টাক্টর ত মহা বিপদে পড়ল আর সে জন্য দুই একজন যাত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণের বৃথা চেষ্টা করছিল। আমি ভেবে পেলাম না কোন পক্ষে যাব। যদি ন্যায় এর পথ ধরি তাহলে আমাকে বাস কন্টাক্টর এর সাপোর্ট করতে হয়। তাহলে আবার অন্য যাত্রীরা বলবেন ভাই আপনি যাত্রী হয়ে, কিভাবে আরেক যাত্রীর বিপক্ষে যাচ্ছেন। উনি এ পথে নতুন ইত্যাদি ইত্যাদি।
আল্লাহ্ তায়ালা মানুষকে সাধারন বিচার বুদ্ধি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। কোনটা ভাল কোনটা মন্দ জ্ঞান দিয়েছেন। তারপর যদি মানুষ অজুহাত বানাই তাহলে সে রেহাই পাবে না। এখন আমি যদি আপনি বাজারে গিয়ে চাল চান, আর আপনাকে আটা দিয়া হয়, তাহলে কি বলবেন যে আমি নতুন তাই বুঝতে পারি নাই। বা আপনি কখনও আলু কিনতে গিয়ে পেয়াজ কিনবেন না আশা করি, তাই না। যদি আমাদের এই সব সাধারন বৈষয়িক জ্ঞান থাকে। তাহলে কেন আমরা সেটা অন্য ক্ষেত্রে ব্যাবহার করতে পারি না। কেন আমরা বার বার একই ভুল করি?! আপনি যেমন ভুল করবেন তার মাশুলও আপনাকে সেই পরিমাণই দিতে হবে। আর এই মাশুলের পরিনাম হইত আপনি বুঝছেন না, কারন এখানে আপনার জীবন জরিত নাই তাই…।
কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে এখানে আরেকটি প্রাণীর জীবন জরিত। ক্রিকেটে যেমন যদি কোন সন্দেহ থাকে তাহলে তা ব্যাটসম্যান এর পক্ষে যায়। কিন্তু তারপরও যখন আপনি সেই সন্দেহ কে আউট না বলে আঙ্গুল তুলে দিচ্ছেন বা লাল বাটনে চাপ দিচ্ছেন। তখন আমরা হতবাক হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। মনে কষ্ট আর ব্যাথা নিয়ে থাকতে হয়। কিন্তু আপনি হয়ত জানতে পারছেন না। আমরা অনেক সময় না জেনেই একটা উপদেশ বা কথা সেই আঙ্গুল তুলার মতই আরেকজনের জীবনের লাল বাতি জ্বালিয়ে দিচ্ছি। তার জীবনটা হয়ত আমাদের ক্রিকেটার দের মত হইত মাথা নিচু করে ফিরছে না সেই না ফিরার দেশে…বরং সে হয়ত মাথা উচু করে খুশি মনেই যাচ্ছে, তার মনের মধ্যে এক অনর্থক সান্তনা নিয়ে যে, আমার মনিব ত আমাকে বাঁচানোর যথেষ্ট চেষ্টা করেছে, না পারলে কি করবে? আমাদের মত হয়ত সেও বলে, হায়াত মওত ত আর মানুষের হাতে না? আর এভাবেই সে তার মনে এক মিথ্যা সান্তনা নিয়ে পরম শান্তিতে তার নিরীহ চোখ টা বুজে আসে, তার কোমল দেহটা নিথর হয়ে আসে একসময়। আমরা অনেক ভাগ্যবান মানুষ হত্যার মত এদের যদি জবাবদিহিতার ব্যাবস্থা থাকত তাহলে হয়ত আমরা এত সহজে, এই প্রাণীটিকে নিয়ে বা তাদের জীবন নিয়ে এভাবে ছিনিমিনি খেলতাম না।
আমাকে কিছুদিন আগে একজন জানালেন যে, কবুতরের ভাল থাকার জন্য একজন জীবাণু নাশক ঔষধ temsen খাওয়া তে বলেছেন, একথা শুনে আমার মাথার চুল খাড়া হয়ে গেল! কেন? এতে কি উপকার হবে! তিনি জানালেন, এতে তার শরীরের বাইরের জীবাণু ত মরবেই, ভিতরের জীবাণু পর্যন্ত মারা যাবে। আমি বললাম ঠিক কথা ভাল উপদেশ। সেই সাথে আপনার কবুতরের সারা জীবনের যত জীবাণু আছে সেটাও মরে যাবে, আর কোন দিন রোগ বালাই হবে না। আর হলেও আপনি তা দেখতে পাবেন না। তিনি আমার রাগের ঝাঁজ তা প্রথমে না বুঝলেও পরে বুঝতে পারলেন। এটা কেন? কেন এভাবে মানুষ উপদেশ দিচ্ছেন? কোন কারন নাই…TV বা মিডিয়া তে নানা ধরনের সাবানের বিজ্ঞাপন প্রতিনিয়ত দেখছেন, যে কিছু জীবাণু নাশক সাবান গায়ে মেখে, নানা রোগ থেকে মুক্ত থাকছেন!? আর এটা দেখেই হয়ত মাথাতে এই আইডিয়াটা এসেছে। একজন আবার সেই জীবাণু নাশক দিয়ে গোসল দিতে বলছেন। তিনি হইত ভুলে গেছেন যে, এই ধরনের জীবাণু নাশক কবুতরের গায়ের জন্য না, বরং এটা খাচা,বা মেঝে বা বাইরের জীবাণু থেকে বাচার জন্য বা মুক্ত থাকার জন্য। আমি কখনও কোন ডাক্তার কে জীবাণু নাশক দিয়ে রোগ চিকিৎসা বা এর প্রতিরোধের জন্য বলতে শুনিনাই। কিন্তু তাহলে এই ধরনের মানুষ কেন, এই উপদেশ দিচ্ছেন, কারন ওই যে, ওনারা নিজেদের সেই আম্পায়ার দের মত ভাবেন। যেহেতু তাকে জিজ্ঞাস করা হয়েছে, যদি জানি না বলা হয়, তাহলে কেমন দেখাই। তাই ভুল হোক সিধান্ত ত একটা দিতেই হবে। আর তাই এই ধরনের লোক নানা ভুল সিধান্ত দিয়ে থাকেন। আর আমরা সেই বাসের যাত্রীর মত ভুল বাসে উঠে পড়ি, জিজ্ঞাস না করেই। তাহলে আসল দোষী কে?
পবিত্র কোরআন এ আল্লাহ্ বলেছেন, “যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তার পিছনে পড়ো না। নিশ্চয় কান, চক্ষু ও অন্তঃকরণ এদের প্রত্যেকটিই জিজ্ঞাসিত হবে।” (সূরা বনি ইসরাইল আয়াতঃ ৩৬)
সাধারন জ্ঞানের জন্য কি এম এ, বিএ, পাস করতে হয়? নাকি নিজের বিবেক বুদ্ধি খাটানই যথেষ্ট? আপনি এই যায়গায় আমি ত নতুন একথা বলে পার পাবেন না! যিনি ভুল উপদেশ দিচ্ছেন,তার থেকেও বেশি অপরাধী যিনি, তার বিবেক বুদ্ধি না খাটিয়ে অবলীলায় এগুলো ব্যাবহার করছেন বা এ ধরনের কাজ করছেন।
পবিত্র কোরআন এ আল্লাহ্ বলেছেন, “আর যদি তুমি দুনিয়ার অধিকাংশ লোকের মত চল তবে তারা তোমাকে আল্লাহ্র পথ থেকে বিচ্যুত করবে,তারা শুধু অনুমানের অনুসরন করে। আর তারা সুধুই মিথ্যা বলে।” (সূরা আনা-আম,আয়াতঃ১১৬)
আল্লাহ্ আরও বলেছেন,”দুর্ভোগ প্রত্যেক ঘোর মিথ্যাবাদী পাপীর” (সুরা জাজিয়া,আয়াতঃ৭)
জানা লোকদের অবস্থা সেয় মাহমুদুন নবীর গাওয়া সেই গানের মত, “আমি সাত সাগর পাড়ি দিয়ে কেন সৈকতে পড়ে আছি।” ছোট বেলায় একটা ছোট্ট ভুলের কারনে আমার মা আমাকে বেল্ট দিয়ে মেরেছিলেন, তার দাগ এখন আমি পিঠে বহন করছি। আমার নিজের অজান্তেই সেই দাগ আমি এখন পর্যন্ত মনের মধ্যেও বয়ে বেড়াচ্ছি, এখনও আমি কোন ভুল করতে গেলে মায়ের সেই মারের কথা মনে পরে যায়, আর পিঠের সেই দাগ আমাকে সেই সব ভুল যাতে না করি সে জন্য অনবরত মনে করিয়ে দেয়। আমারা সবাই এরকম ছোট বড় দাগ শরীরে বা জীবনে বহন করে বেড়াচ্ছি, কিন্তু পার্থক্য হল এই যে, আমরা কেউ উপলব্ধি করি আর কার সেই উপলব্ধিটা ভোতা হয়ে গেছে। আজ আমরা এক অশুভ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, আর সেটা নামের হোক আর যাই হোক।
আল্লাহ্ বলেছেন,”আল্লাহ ইচ্ছা করলে তোমাদের সবাইকে এক জাতি করে দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি যাকে ইচ্ছা বিপথগামী করেন এবং যাকে ইচ্ছা পথ প্রদর্শন করেন। তোমরা যা কর সে বিষয়ে অবশ্যই জিজ্ঞাসিত হবে।” (সুরা আন নাহাল আয়াতঃ৯৩)
যারা সত্যিকারই কবুতরের বিভিন্ন বিষয় ভাল জানেন অর্থাৎ যারা বড় খামারি নামে পরিচিত, তারা সাধারণত মানুষের উপকার করতে চান না, কারন কি? জানা নেই, হয়ত ভাবেন, অরেকজনকে উপদেশ দিয়ে লাভ কি, বা হয়ত ভাবেন যে উপকার হলে ত আর নাম করবে না, কিন্তু অপকার হলে বদনাম করবে। কিন্তু কেন আমরা না বা বদনামের চিন্তা করব, আমরা ‘ফি সাবিলিল্লাহ…।’ হিসাবেই ত করব আল্লাহ্ ওয়াস্তেই ত করব আল্লাহ্ কে রাজি খুশি করার জন্নই ত করব।
আর তাই হয়ত এই ধরনের লোকদের সম্পর্কে আল্লাহ্ বলেন, “যারা কৃপণতা করে এবং মানুষকে কৃপণতার নির্দেশ দেয় এবং আল্লাহ্ নিজ অনুগ্রহে তাদের যা দিয়েছেন তা গোপন করে আল্লাহ্ তাদের ভালবাসেন না।”(সূরা আন নিসা,আয়াতঃ৩৭)
কিছুদিন আগে এক বিদেশী যিনি গার্মেন্টস শিল্পের সাথে জরিত, তাকে নিয়ে যাচ্ছিলাম, তিনি আমাকে একটি সাইন বোর্ডের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন ওটা কি দেখলাম একটি মধুর বোতলের ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়া, সেখানে লিখা আছে, “এখানে খাঁটি মধু পাওয়া যায়।” কিন্তু লজ্জাই বলতে পারলাম না, কথাটা ঘুরিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলাম। কেন? কারন তারা সবাই জানে মধুতে ভেজাল হবার কোন যুক্তি নেই, তাই খাঁটি কথাটাও লিখার কোন যুক্তি নেই…সেখানে লিখার দরকার ছিল…এখানে মধু পাওয়া যাই। আর আমরা সবাই নিঃসন্ধেহে সেটা কিনতে পারতাম। কিন্তু এটা আমাদের দেশে হয় না, আর তাই এখানে খাঁটি মধু,খাটি দুধ, খাঁটির খোঁজে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। আমাদের দেশে আজ সবক্ষেত্রেই একই অবস্থা, এই জন্যই ত কবুতরের বিজ্ঞাপনে দেখতে হয়, ভ্যাক্সিনেটেড, ইম্পরটেড, রিং এর পেয়ার, ডিজিজ ফ্রী ইত্যাদি। কেন? কারন আজ আমাদের মানুষের মধ্যেও ভেজাল…মনের মধ্যে ভেজাল…চিন্তা চেতনার মধ্যে ভেজাল…কাজে ও কর্মে ভেজাল…আর এর থেকে আপনি মুক্তি পাবেন না। কোথায় যাবেন আর কি করবেন আপনি আমি চিন্তা করে কিছুই করতে পারব না। তবে কিছু করতে না পারি এই সব লোকদের জন্য দোয়া ত করতে পারি, যেন আল্লাহ্ এসব লোকদের হেদায়েত দান করেন, এই ধরনের লোকদের মনের, চিন্তার, চেতনার মধ্যে যে রোগ আছে তা যেন ভাল করে দেন, এদের সত্য ও ভাল পথে চলার তৌফিক দান করুন(আমীন)। এছাড়া আপনি আমি আর কি বা করতে পারি। তবে হ্যা মনে রাখতে হবে, আমরা যদি অন্যায় এর প্রতিবাদ করতে শারীরিক ভাবে না পারি, তাহলে মানসিক ভাবে, তাও যদি না পারি তাহলে অন্তত পক্ষে তাদের জন্য পাশে ত একটু থুথু ফেলতে পারি! এটা আমার কথা না হাদিসের কথা। যাই হোক এখন সময় এসেছে, আপনার বন্ধু চিনেনিবার, আর যদি এটা ঠিকমত না করতে পারেন। তাহলে আমার পিঠের দাগের মত আপনিও আপনার মনের মধ্যে প্রতারনা আর প্রতারিত হবার,অবিশ্বাস ও বিশ্বাস হারানোর, ঠকবাজির মত দাগ বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে চিরকাল।
আল্লাহ্ পবিত্র কোরআনে বলেছেন,“হে বিশ্বাসীগন! তমাদের আপনজন ব্যাতিত অন্য কাউকেও অন্তরঙ্গ বন্ধুরুপে গ্রহন করনা। তারা তোমাদের বিভ্রান্ত(অনিষ্ট)করতে ত্রুটি করবেনা, যা তোমাদের বিপন্ন করে তাই তারা কামনা করে। তাদের মুখে বিদ্বেষ প্রকাশ পায় এবং যা তারা অন্তরে গোপন রাখে তা আরও গুরুতর। তোমাদের জন্য নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বিবৃত করছি, যদি তোমরা অনুধাবন কর। ”(সূরা আল ইমরান, আয়াতঃ১১৮)
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ কোরআনে আর বলেছেন, “যদি তোমাদের কোন মঙ্গল হয় তারা দুঃখিত হয়, আর তোমাদের অমঙ্গল হলে তারা আনন্দিত হয়। এবং তোমরা যদি ধৈর্য ধর এবং সাবধান হয়ে চল তবে তাদের ষড়যন্ত্র তোমাদের কিছুই করতে পারবে না। তারা যা করে নিশ্চয় আল্লাহ্ তা পরিবেষ্টন করে রয়েছেন।” (সূরা আল ইম্রান,আয়াতঃ১২০)
মূল লেখক : সোহেল রাবি ভাই
ভুল সবই ভুল (কবুতর কেস স্টাডি ৩য় পর্ব) BD Online Pigeon Market

Pigeon Discussion, Pigeon Diseases & treatment
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন